ভারতীয় রেলের এক স্বল্পজানা কাহিনী (সত্য ঘটনা) – প্রীতম ধারা
ভারতীয় রেল ‘ট্রেন লেট’ নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টার খোরাক হয়েছে, কিন্তু ট্রেন সময়ের আগেই ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনও শোনা গেছে কি ?
তাহলে শোনা যাক একজন অতি ‘সাধারণ’ মানুষের ‘অসাধারণ’ হয়ে ওঠার কাহিনী …(ভারতীয় রেলের গর্ব)
সেদিনটা ছিল ২রা ডিসেম্বর, ১৯৮৪ সাল …মাঝরাত !
সময় হবার আগেই সেই রাতে একটা মেল ট্রেনকে স্টেশন থেকে জোর করে রওয়ানা করিয়ে দেওয়া হয়, আর নিজে দাঁড়িয়ে থেকে কাজটি করান খোদ ডেপুটি স্টেশন সুপার !
অবাক কাণ্ড ! অবাক কান্ড !
এরজন্য রেল তাকে শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল, স্টেশন প্লাটফর্মে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখা হয় তাঁর নাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ, এই কাজটিই করেছিলেন গোলাম দস্তাগীর, সেন্ট্রাল রেলের এক পদস্থ কর্মচারী আজ থেকে ঠিক আটত্রিশ বছর আগে।
রোজকার মতন রাত দশটায় স্টেশনের ডিউটিতে এসেছিলেন গুলাম। জমে থাকা কিছু ফাইল দেখতে দেখতে কখন যে রাত একটা বেজে গেছে খেয়াল করেন নি। প্লাটফর্মে গোরখপুর মুম্বই এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াতে আড়ামোড়া ভেঙে অফিসের বাইরে এলেন।
প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই চোখ দুটো তার তীব্র জ্বালা করে উঠলো, গলা এমন শুকিয়ে গেল যেন দমবন্ধ হয়ে যাবে।
তখনও উনি জানতে পারেননি স্টেশন মাস্টার সহ তেইশজন রেলকর্মী ইতিমধ্যেই শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে।
না আর বিলম্ব না…
কিছু একটা ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটেছে আন্দাজ করে উনি সাথে সাথেই খবরটা জানালেন মধ্য রেলের কন্ট্রোল রুমে, দুদিকের বিদিশা আর ইটারসি স্টেশনে খবর দেন কোন ট্রেন যেন সেখান থেকে ছেড়ে এদিকে না আসে।
এবারে তার নজর গেলো এক্সপ্রেস ট্রেনটার দিকে।
কেবিনে সিগন্যাল সবুজ করতে বলে ছুটে গেলেন ইঞ্জিনের দিকে। ড্রাইভার কে বললেন এখুনি ট্রেন ছাড়ার জন্য। বিস্মিত চালক যখন বললো, ছাড়ার সময় আসতে এখনও পনেরো মিনিট বাকি, উনি দায়িত্ব নিয়ে লগবুকে লিখে দিলেন। হাজারের ওপর যাত্রী নিয়ে নিরাপদে বেরিয়ে গেল এক্সপ্রেস ট্রেনটি।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছেন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে দেখতে পেলেন এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ দায়িত্বশীল মুখ ?
হ্যাঁ বন্ধুরা, সাঁইত্রিশ বছর আগে এক রাতে ভূপালের Union Carbide কারখানার স্টোরেজ ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এসেছিল প্রায় ৩০ টন বিষাক্ত methyl isocyanate বা মিক গ্যাস। যার প্রভাবে সে-রাতে ছয়লক্ষ মানুষের স্বাভাবিক জীবনটাই গেলো বদলে ।
হাজার হাজার মানুষ যারা মারা গেলো সেদিন তারা তো একদিক দিয়ে বেঁচে গেলো, বাকিরা কেউ বিকলাঙ্গ কেউ অন্ধ কেউ ভয়ঙ্কর ফুসফুস বা চর্মরোগ নিয়ে দগ্ধে দগ্ধে বেঁচে ছিল বাকি জীবন।
আমাদের কাহিনীর নায়ক কিন্ত ট্রেনটা ছেড়ে যাবার পরও সে-রাতে তার বউ বাচ্চার হাল দেখতে কোয়ার্টারে ফিরে যাননি।
চারিদিকে ফোন করে ডাক্তার ও ambulance আনিয়েছেন বিষাক্ত গ্যাসের ছোবলে যারা প্ল্যাটফর্মে ছটফট করছিল তাদের জন্য। সারারাত নাকে রুমাল বেঁধে আচ্ছন্ন সহকর্মীদের হাসপাতালে পাঠিয়েছেন, যোগাযোগ রেখেছেন আশেপাশের সব স্টেশনের সাথে।
রাত কেটে সকাল হলো একসময়…
এতক্ষণে মনে পড়লো তার পরিবারের কথা।
ক্লান্ত আচ্ছন্ন গুলাম দস্তাগীর কোনক্রমে শরীরটা টানতে টানতে পৌঁছালেন রেল কোয়ার্টারে।
গ্যাসের ছোবল ততক্ষণে কেড়ে নিয়েছে তার এক পুত্রকে, আরেকজনের সারা শরীরে ছড়িয়েছে সংক্রমণ।
সারারাত গ্যাসের প্রত্যক্ষ স্পর্শে থাকার দরুন গোলাম সাহেবেরও শ্বাসনালী হয়েছিল ভীষন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বাকি জীবনটা তাঁকে বাড়ি আর হাসপাতাল করেই কাটাতে হয়েছিল।
এর পর 2003 সালে দুনিয়া থেকে কিছুটা অভিমান নিয়েই বিদায় নেন এই (অ)সাধারণ মানুষটি ……ভারতীয় রেলের গর্ব ….
মৃত্যুর কারণ হিসাবে সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছিল
“Suffering from diseases caused as a direct result of exposure to MIC (Methyl Isocyanate) gas.”
অজানা জ্বর নয়।
কে যেন বলেছিলেন..,
“A hero is an ordinary individual who finds strength to persevere and endure in spite of overwhelming obstacles.”
আজকের এই স্বার্থপর দুনিয়ায় মাঝে মাঝে আচমকাই চলে আসেন এইসব মৃত্যুহীন প্রাণ, মানবিকতার খাতিরে কোন প্রত্যাশা ছাড়াই আমাদের জন্য রেখে যান এক অভূতপূর্ব উদাহরণ …তাই না ?
হ্যাঁ বন্ধুরা ভারতীয় রেলের ইতিহাসের খাতায় লেখা আছে গোলাম দস্তাগীর(ডেপুটি সুপার, ভূপাল, সেন্ট্রাল রেল) এর নাম।
ভারতীয় রেলের সাথে আমরাও বার বার তাঁকে কুর্নিশ জানাই। 🙏🙏
খুব ভালো লেখা প্রীতম বাবু। ঘটনার গুণে লেখায় প্যাঁচপয়জার না রেখেও আপনার এই লেখা সহজেই মন ছুঁয়ে যায়। সচল থাকুক আপনার স্বাদু কলম।