Call me Devil – সোমা বৈদ্য
(১)
— “আমি ভূত-প্রেতে তেমন ভয় পাইনা। আমি বলছিনা যে আমি জিন ভুত বিশ্বাস করিনা, অবশ্যই বিশ্বাস করি”।
— “তবে কি তুমি বলতে চাইছো যে, তুমি কখনোই ভয় পাও না, তুমি কি নির্ভিক?”
— “আমি ভয় পাই তবে এসব জিন ভূতে নয়, আমি বেশি ভয় পাই এই দুনিয়ার মানুষদেরকে। একটা আশ্চর্যজনক
বিষয়ে জানো? এই পৃথিবীতে জিন ভূতের চেয়েও খুব বেশি ভয়ংকর হচ্ছে এই মানুষ নামক প্রজাতিটি।”
— “আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সেরা জীব। আর আপনি তাদের সবচেয়ে ভয়ংকর বানিয়ে
দিলেন? মানুষের ভিতরে মানবিকতা আছে, একজন আরেকজনকে সাহায্য করে সহযোগিতা করে, পাশে দাঁড়ায় আর
এদেরকে আপনি ভয়ংকর বলবেন? বিষয়টা কি হাস্যকর নয়? আপনি কি কখনো দেখেছেন অন্য কোন প্রাণী এভাবে
তাদের নিজেদের জন্য এগিয়ে আসছে? কিন্তু মানুষ ঠিকই মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ায়। বিপদে সহায়তা করে। তবে
হ্যাঁ কিছু এক্সেপশনাল আছে, কিন্তু আপনি এই এক্সেপশনাল দের ধরে সমগ্র মানবজাতিকে বিচার করবেন এই ধারণাটা
একদম ভ্রান্ত।”
দেবযানীর কথাটা শুনে আবির বেশ বিচলিত হয়ে গেলেন। আবিরের বয়স ৪৭ বছর। একজন সরকারি কর্মকর্তা
তিনি, এখনো বিয়ে করেনি। একটু অন্যরকম, চুপচাপ স্বভাবের একজন মানুষ, সবার সাথে তেমন যায় না তার।
আবার সবার সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক যেন সবাই তাকে আপনজন মনে করে। কিন্তু আবিরের এই জিনিসটা ভালো লাগে না।
আজ তার অফিসের এক জুনিয়র কলিগ তার সাথে নিজ থেকে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসলো। আবিরের মত মানুষ
চায় অফিসের লাঞ্চ টাইমে একটু নিজে একান্ত সময় কাটাতে। আর এই দিকে দেবযানীর মত এমন আপদ এড়ানো বেশ
কষ্টসাধ্য ব্যাপার। আবির উত্তর দিলেন, “দেখো দেবযানী, আমি কোন প্রেক্ষাপটে এই কথা বলেছি সেটা তোমার বোঝা
উচিত ছিল, যেহেতু তুমি বোঝোনি তার মানে তোমার এখনও এসব বোঝার বয়স হয়নি। আর এই ব্যাপারে এখন
আমার কোন লজিক বা প্রমান দেওয়ার ইচ্ছা নাই। আমরা পরে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলব।” কথাটা বলেই আবির অফিসের ক্যান্টিন থেকে উঠে চলে আসলো।
আর এদিকে দেবযানী ফ্যাল ফ্যাল করে আবিরের চলে যাওয়া দেখছিল পিছন থেকে। হঠাৎ করে ই সে বেশ জোর
গলায় উঠে বলতে লাগলো, ” হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝি বুঝি, মানুষ যখন এভাবে কথার মার -প্যাঁচে আটকে যায়, তখন তারা ভাব
ধরতেই এসব জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলে চলে যায়। এসব নাকি বুঝিনা! কি ভেবেছেন আমরা বুঝিনা?”
(২)
মেধাবী এক তরুণী দেবযানী। বয়স ২৬ -২৭ এর কোঠায়। বাড়িতে এক ছোট ভাই আর মা আছে। এসএসস
পরিক্ষার সময় দেবযানীর বাবা মারা যায়। তার বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে মোটামুটি এই পর্যন্ত চলে আসছিল
‘দেবযানীর পরিবার। এখন আর ওদের জীবনে কষ্ট নেই। কারণ, দেবযানী ভালো চাকরি পেয়ে গিয়েছে। তার
‘বেতনেই পরিবারের সব ভরণপোষণ সহ ভবিষ্যতের জন্য তারা এখন অর্থ জমা করতে সক্ষম হয়েছে। আজ
দেবযানীর এই অনন্য পরিশ্রমের জন্য তার পরিবার বেশ সচ্ছলতার সাথে জীবন পার করছে। দেবযানী যে অফিসে
কাজ করে সেখানেই তার এক সিনিয়র রয়েছেন নাম মিঃ আবির ব্যানার্জি। লোকটা বেশ মিশুক আছে। কেউ আগ
বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে সে কথা বলে। দেবযানী কখনো দেখেনি যে, আবির নিজে কোন সমস্যা নিয়ে একমাত্র তার
অফিসের বস ছাড়া অন্য কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে। আবির মধ্য বয়সি একজন ব্যক্তি। লোকটা দেখতে
মোটেও সুদর্শন না। দাড়ি হালকা পেকে গেছে। চুলের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু সাদা চুলও বের হচ্ছে। কিন্তু মজার
ব্যাপার হচ্ছে লোকটা এখনো বিয়ে করেনি। ঝষির কাছে একটা অন্যরকম চরিত্র এই আবির। লোকটা বেশ চুপচাপ
স্বভাবের। মাঝে মাঝে টুকটাক দার্শনিক কথাবার্তা বলে। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি বেস্ট এমপ্লয়ি খেতাব নিয়ে
দৌড়ে বেড়াচ্ছে। দেবযানীর ধারণা আবির জীবনে হয়তো অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছে অথবা তার জীবনে এমন
বিস্ময়কর কিছু হয়ে ঘটেছে যার কারণে আবিরদা এরকম স্বভাবের হয়ে গিয়েছেন।
“দেবযানী একটু শুনবেন? ক্যান্টিনে আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।”। আবিরের কথা শুনে দেবযানী বেশ অবাক
হয়ে গেল, আবির কখনোই তার সাথে এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি, হয়তো আজকে গুরুত্বপূর্ণ কোন কথাই বলবে।
(ক্যান্টিন)
— “আচ্ছা দেবযানী! সাইকোগ্যাথ সিরিয়াল-কিলার সম্পর্কে জানো?”
— “হ্যাঁ জানি, এরকম অনেক মুভিও আমি দেখেছি কিন্তু কেন?”
— “একটা বিষয় খেয়াল করেছো? তুমি আজ অস্দি যত মুভি দেখেছো এসব সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে, একটা বিষয়
খেয়াল করলে দেখবে এতে সব ভিলেন দের সাথে কিন্তু আমার স্বভাবটা বেশ মিলে যায়। একটু চুপচাপ থাকবে,
‘দার্শনিক কথা বলবে, একটু অসামাজিক ভাবে চলবে, আর গোপনে তারা এসব সিরিয়াল কিলিং করবে। আমাদের
দেশেও কিন্তু এরকম মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা দেখা যায়, যেগুলো কোন অজানা সিরিয়াল কিলার দ্বারা সংগঠিত হয়।”
— “এসব কেন বলছেন আপনি কি সিরিয়াল কিলার নাকি?” দেবযানী আবার একটু মজা করে একটু সামনের দিক
এগিয়ে ফিসফিসিয়ে আবিরবাবুর কাছে নিজের মুখে হাত দিয়ে বলল, “কয়টা খুন করেছেন শুনি? আমার আবার এসব
খ্রিলার খুব ভালো লাগে।”
— “খারাপ বল নাই, আমি জানি, সিরিয়াল কিলারের যেসব বৈশিষ্ট্য আছে ওই বৈশিষ্ট্য গুলো খুব ভালো মতোই যায়
আমার সাথে। আর তোমার তুমি তো তুমি এটাও ভাবতে পারো যে আমি ভাব ধরতে এই সব ফিলোসফিক্যাল
কথাবার্তা বলি, চুপচাপ থাকি। বিষয়টা আসলে এমন না আমি ছোটবেলা থেকেই এমন। বাবা মা ছাড়া বড় হয়েছি,
আমার কোন আত্মীয় নাই। একরকম ধরতে পারো আমি জারজ সন্তান। আমার কাছে আমার কোন অস্তিত্ব নাই।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন প্রেম করেছিলাম, কিন্তু আমার এই স্বভাব তার পছন্দ ছিল না। তাই তার সাথে আমার
বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। তবে আমার বিয়ে না করার সাথে এই বিচ্ছেদের কোন সম্পর্ক নেই।”
— “হুম বুঝলাম, তবে একটা মজার বিষয় জানেন? আমি মোটামুটি আপনার লাইফটা ইমাজিন করতে পারছিলাম। তবে ভাবছিলাম একটু আনকমন কোন কাহিনী থাকবে আপনার। আমি বেশ এক্সসাইটেড ছিলাম। কিন্তু এখন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, ওই রেগুলার চুপচাপ একাকী একটা ছেলের কাহিনী আর আপনার কাহিনী মোটামুটি একই। আচ্ছা আপনার প্রাক্তন প্রেমিকার কি অবস্থা? কি করে সে এখন?”
আবির এবার দেবযানীর মত একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল, “মেরে ফেলেছি তাকে। সাইকোপ্যাথ এর মত।” জব্বার ক্যান্টিন থেকে উঠে চলে গেল তার ডেস্ক এ। দেবযানী মোটামুটি এক রকম খতমত খেয়ে গেল। কি বলে এই ‘লোক? প্রেমিকার শোকে ওনার মাথাটা হয়তো চলে গিয়েছে। দেখে মনে মনে ভাবছে আবির বোধহয় ওকে কনফিউজড করার চেষ্টা করতেছে অথবা আবিরের উপর ওর ইন্টারেস্ট বাড়ানোর একটা পরিকল্পনা করতেছে। কিন্তু দেবযানী তো এই ফাঁদে পা দেয়ার মত মেয়ে নয়। দেবযানী পিছন থেকে উঠে আবার জোর গলায় বলতে লাগল, “আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনাকে দিয়ে এসব সম্ভব, আর আপনার এসব আজগুবি গল্প বানিয়ে বলার দরকার নাই। কারণ, আমি এমনিই আপনার উপর ইন্টারেস্টেড, আপনার কষ্ট করে এসব আজগুবি গল্প বলে আমার আগ্রহ বাড়ানোর কোন দরকার নাই।”
আবির ক্যান্টিন থেকে চলে আসলো তবে দরজা থেকে বের হওয়ার আগে প্রথমবারের মতো সে অফিসের ক্যান্টিনে মুচকি হেসে বেশ জোর গলায় বলল, “পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে ভয়ংকর কিন্তু কিছু নেই দেবযানী।”
আবিরের এই উত্তরে বেশ খটকা লাগলো দেবযানীর, সে চুপ হয়ে বসে রইল। অফিসের ক্যান্টিনের সবাই একটু খতমত খেয়ে গেল! কি ব্যাপার? আবির তো তারা কখনোই এভাবে এত উচ্চ স্বরে কথা বলতে তো দেখেনি তাও আবার অফিসের এক জুনিয়র ফিমেল কলিগের সাথে? পাশ থেকে আবিরের একজন কলিগ দেবযানীর দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝলা দেবযানী, এই মিঃ আবির কারো সাথেই তেমন কথাই বলে না, তবে প্রায় প্রায় দেখি তোমরা দুজন টুক টাক কথা বলো। পারলে লোকটাকে একটু মানুষ আর সামাজিক করার চেষ্টা কইরো। এভাবে মানুষ বাঁচে নাকি?” দেবযানী কিছুটা বিচলিত চোখে ক্যান্টিনের দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ দেবযানী একটু মুচকি হেসে কানে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউব থেকে “Lucifer-Call me Devil” নামের একটা গান ছেড়ে, আস্তে আস্তে খাবার খাওয়া শুরু করে দিল। দেবযানী গানের মাঝে মাঝে হঠাৎ খাওয়া বন্ধ করে মুচকি হাসে, আবার খায়। দেবযানীর দুই চোখ জ্বলজ্বল করছে, কিছু একটা বলতে চায় দেবযানীর চোখ।
অসংখ্য ধন্যবাদ সোমা তোমাকে, এরকম লেখা উপহার দেওয়ার জন্য 🙏
পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম 💌