একটু উষ্ণতার জন্য – সূর্যাশীষ ঘোষ
বহুদিন আগে গ্রীষ্মের এক দুপুরের কথা..
কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরছি, সেদিন ছিল মিটিং মিছিলের দিন তাই রাস্তায় যথারীতি বাস প্রায় নেই বললেই চলে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দূরে দেখতে পেলাম একটা এসি বাস সামনের দিকে আসছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়ায় প্রথমে একটু সংকোচবোধ করলেও কোনো উপায় নেই, এসি বাসে না উঠলে বাড়ি ফিরতে পারবো না যে, তাই কোনো বাস না পেয়ে আমাকে ওই ব্যায়বহুল এসি বাসেই উঠতে হলো।
যেহেতু দিনটা ছিল ভোট প্রচারের দিন তাই মানুষ সতর্ক হয়ে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে সেদিন রাস্তায় বেরোয়নি এবং কস্টলি হওয়ায় বাসটা খালিই ছিল। আমি উঠে আমার পছন্দ মত ডাবল সিটের জানলার ধারে গিয়ে বসলাম।
খানিকক্ষণ বাসটা এগোনোর পরেই এক তরুণী হাত দেখালো, সেই দেখে বাসের কন্ডাক্টর কাকু যথারীতি ড্রাইভার কে বাস থামানোর জন্য বেল বাজিয়ে তাকে বাসে তুললো। আমি তখন দুই কানে হেডফোন নিয়ে বিয়ে.কম মুভি দেখছিলাম তাই তখন ওইসব লক্ষ্য পড়েনি আমার। তবে একটু অন্যমনস্ক হতেই দেখলাম একটা সুন্দরী মেয়ে গেটের কাছে দাড়িয়ে বাসের পিছনের দিকে মুখ করে ডান দিক বাম দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছে। আসতে আসতে হটাত আমার ডান দিকের সিট টা খালি দেখতে পেয়ে সেই দিকে মেয়েটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
তারপর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো বাসের এত সিট ফাঁকা থাকতেও মেয়েটি আমার ডান দিকের সিটে বসার ঠিক পূর্বে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“এক্সকিউজ মি, এই সিট টা কি কারোর জন্য রাখা?”
আমি তখন অবাক হয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম, “না” ৷
তখন মেয়েটি তার ব্যাগটা তাড়াতাড়ি কাঁধ থেকে নামিয়ে আমার সাইডে বসে পড়লো।
তারপর থেকেই লক্ষ্য করলাম মেয়েটি আমার দিকে মাঝেমাঝেই আড়চোখে তাকাচ্ছে। তখন আমি কিঞ্চিৎ ওকওয়ার্ড ফিল করতে লাগলাম। আমার আর মুভি দেখার দিকে একদমই মন নেই তাও মুভিটা বন্ধ করলাম না বরং মোবাইল এর সাউন্ডটা একটু কমিয়ে দিলাম যাতে করে মেয়েটি কিছু বললে শুনতে পারি। আমি আমার মুভি দেখা কন্টিনিউ করছি সেই সময় বিয়ে.কম মুভিটার পায়েলের সেই রোমান্টিক সিনের মুহূর্তে লক্ষ্য করলাম মেয়েটি আমার মোবাইল এর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছে আমি কি দেখছি। তখন আমি একটু লজ্জিত হয়েই মোবাইলটা আড়াল করতে চাইলাম।
তখন দেখি মেয়েটি আমায় বললো, “তুমি যদি কিছু মনে না করো,তাহলে একটা কথা বলতে পারি?”
আমি তখন আরো অবাক হয়ে হালকা ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ই্যা বলুন”।
মেয়েটি তখন একটু খুশি হয়েই বললো,”আমাকে তোমার সিট টাই বসতে দেবে?” (জানলার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)
আমি তখন কথা না বাড়িয়ে তাকে আমার সিট টা ছেড়ে দিলাম। তখন আমি মুভি দেখার মুডে না থাকায় বন্ধ করে দিয়ে জাস্ট হেডফোনটা কানে লাগিয়ে রেখেছি। দিয়ে মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে শুরু করলাম। আমি বেশ অবাকই হলাম যে একটা মেয়ে প্রথম একটা ছেলে কে দেখলো, প্রথম দেখাতেই সে আমায় “তুমি” বলে ডাকতে শুরু করে দিলো।
ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি আবার আমায় বললো, “তুমি যাবে কোথায়?”
আমি তখন প্রপার জায়গাটার নাম না বলে এক কথায় বললাম,”ঘাটাল”।
সে তখন খুব উত্তেজিত স্বরে বলল, “ওহহ ঘাটাল, ঘাটাল আমি জানি তো খুব ভালো জায়গা”।
আমি তখন কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম। (তারপর খানিক্ষণ সময় পুরোপুরি চুপচাপ)
তারপর মেয়েটি এদিক ওদিক তাকিয়ে আমায় বললো ,”তোমার কি এখানে বাড়ি, না কোনো আত্মীয় বাড়ি?”
আমি তখন একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “দেখুন আমি আর কথা বলতে পারছি না” (মনে মনে ভাবলাম মেয়েটার কি কোনো কাজকর্ম নেই, একতো এত সিট থাকতে এখানে এসে বসলো তারপর বসার পর থেকেই সমানে আমার সাথে বকে চলেছে, কি উদ্দেশ্য কে জানে?)
মেয়েটি তখন আবার বললো, “আচ্ছা তুমি ঘাটালের কোথায় নামবে?”
আমি তখন রেগে আর কিছু কথায় বললাম না। মেয়েটি তখন মৃদু স্বরে আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,”বাব্বা এতো আ্যাটিটিউড, আমি কিছু বলছি কোনো উত্তর দেবারই প্রয়োজন মনে করছে না”।
আমি তখন আর চুপ না থেকে বললাম, “আপনার এত কৌতুহলই বা কিসের? আপনি একটা আলাদা মানুষ, আমি একটা আলাদা মানুষ”।
(এটা বলার পর মেয়েটি এমন কথা আরম্ভ করলো যে আমাদের কথা আর শেষ হবার নয়, আমি বুঝলাম যে ও একটা কথা, আমি একটা কথা এইভাবে বলতে বলতে আমাদের কথা চলতেই থাকবে তাই আর তার দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমি আমার মোবাইল এর মাই জিও আ্যাপ খুলে মিউজিক শুনতে শুরু করলাম)
তখন মেয়েটি আবারও বকবক করতে লাগলো কিন্তু একটাও আমার কানে পৌঁছেলো না তাই আমার কাছ থেকে মেয়েটি কোনো রিপ্লাই পেলো না। মেয়েটি কোনো রিপ্লাই না পেয়ে বিরক্ত হয়ে আমার কান থেকে হেডফোন টা খুলে দিল।
আমি তখন প্রচন্ড রেগে গিয়ে বাকি থাকা আরেকটা কানের হেডফোনের তার খুলে বললাম, “আপনি চুপ করে বসবেন না আমি উঠে চলে যাবো?”
সেই দেখে বাসের কন্ডাক্টর ছুটে এসে বললো, “কি হয়েছে দাদা? এনি প্রবলেম?”
আমি বললাম,”কিছু না কাকু, আপনি যান”৷
কন্ডাক্টর চলে যেতেই মেয়েটি একটু হেসে মৃদু স্বরে বললো, “এদিকে ছেলের টনটনে জ্ঞান, বাসের কাকুকে কিছুই বললো না, এতই যদি বিরক্তিভাব তাহলে বাসের কাকুকে বলে আমার অন্য জায়গায় বসার বেবস্থা করলেই পারতো বা ওই ই অন্য জায়গায় গিয়ে বসতে পারতো”।
আমি তখন বললাম, “আপনি ঠিক কি চাইছেন বলুন তো?”
মেয়েটি তখন এক অদ্ভুত শক্তি নিয়ে বললো, “তোর খুব ইগো, তাই না? টা না হলে আমি প্রথম থেকেই তোকে তুমি তুমি করছি আর তুই সেই আমাকে আপনি বলা ছাড়ছিস না”।
আমি তখন অবাক হয়ে লজ্জায় কিছু না বলতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম । (আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম মেয়েটি কি বুঝতে পেরে গেছে যে। আমার অনিচ্ছাতেই হয়তো আমার মনে একটু একটু ওর প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়েছে এবং ও কি এটাও বুঝে গেলো যে, আমি নিজে থেকে কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারি না বা সুন্দর সুন্দরী মেয়ে দেখেলে একটু লাজুক টাইপের হয়ে যায় বলে)
তারপর আমাদের কথা এরম ভাবে চলছিল..
(মেয়েটি খুব জোর হাসতে শুরু করলো , হাসি থামছে না দেখে আমি আবার বললাম)
আমি তখন গেটের কাছে টিকিট কেটে নামবো বলে দীড়িয়ে আছি, তখন দেখি প্রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে, আমি চোখে চোখে একটু স্বান্তনা দিয়ে নেমে গেলাম। ঠিক তখনই আমাদের দুজনেরই মনে পড়লো আমরা আমাদের কারোরই কন্টাক নাম্বার শেয়ার করিনি। কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছি শেয়ার করতে। তখন বাস রাধানগর থেকে ছাড়ার মুহূর্তে। প্রিয়া তখন বুঝতে পেরেছে যে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য কোনো মাধ্যম নেই তারপর সে কি করবে বুঝতে পারছে না, ও ভেবেছে আর হয়তো আমাদের কখনো কথাই হবে না। আমি তখন ওকে সোশালমিডিয়ার আভাস দিই।
তারপর অনেক দিন বাড়িতে ব্যাস্ততার জন্য ওর সাথে যোগাযোগ করা হয়নি। তারপর হটাত একদিন দেখি আমার এফবি তে ওর একাউন্ট থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট, আমি আ্যাকসেপ্ট করার দশ মিনিটের মধ্যেই মেসেঞ্জারে মেসেজ আসলো,
“আমি জানতাম তুই আমায় ভুলে যাবি, আমাদের প্রেম টাকে তুই বাস থেকে নেমেই মেরে ফেলেছিস, তাও আমি তোকে মনে করানোর জন্য আমি এতদিন বাদে পিং করলাম”
এইভাবে আমাদের কথোপকথন চলতে লাগলো। কিছুদিন পরে আমাদের বিয়ে।
গল্পে ব্যাবহৃত প্রত্যেকটি চরিত্রই কাল্পনিক এবং গল্পটি আমার জীবনের সাথে কোনোরূপ মিল নেই। গল্পটি নিছকই মনোরঞ্জনের জন্য লেখা, এর সাথে বাস্তব জীবনের কোনো মিল নেই, গল্পে ব্যাবহৃত জায়গার নাম সত্যি। কোনো ব্যাক্তির সাথে গল্পটা মিলে গেলে আমি কোনোরূপ দায়ী নই।